Discover millions of ebooks, audiobooks, and so much more with a free trial

Only $11.99/month after trial. Cancel anytime.

রুদাবা (Rudaba)
রুদাবা (Rudaba)
রুদাবা (Rudaba)
Ebook433 pages3 hours

রুদাবা (Rudaba)

Rating: 5 out of 5 stars

5/5

()

Read preview

About this ebook

ভুমিকা---

গল্প লেখার পিছনে সবসময় একটা গল্প থাকে। আমার "রুদাবা" উপন্যাসটি লেখার পিছনেও একটি গল্প রয়েছে।

২০১৮ সালের শেষের দিকে। আমার প্রথম উপন্যাস "হেডিসের রাজ্যে" পেন্সিল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও আমি তখনো বইটি চোখে দেখিনি। এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দেশে এসে পড়লাম বইমেলায় উপস্থিত থাকবার জন্য।

লেখালেখি শুরু করেছিলাম হঠাত করে, কাকতালীয়ভাবে। আমার আত্মীয়স্বজন কাউকে জানাইনি। দুইএকজন জানত, কারণ তারা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিল, সে থেকে পেন্সিলেও এসে পড়েছিল। দেশে এসে জানতে পারলাম আমার চাচা ফুফু অনেকে আমার বইটি পড়েছে, খুব খুশিও হয়েছে। জেনে অবাক খুশি দুইটাই হয়েছিলাম।

সবচাইতে আশ্চর্য হলাম আমার নব্বই বছর বয়সী মেঝকাকুর সাথে দেখা করতে গিয়ে। উনি আমাকে একপাশে ডেকে বই নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন, আমার অন্য আরেকটা বই নিয়ে অনুযোগ করলেন

--- এত ছোট কেন!

আমি হেসে ফেললাম।--- কাকু, এটা তো বাচ্চাদের বই।

তারপর বললেন--- তুমি বিদেশের জীবন নিয়ে লিখো।

আমি বললাম--- জি, কাকু।

ফিরে এসে অন্য লেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম কিন্তু থেকে থেকে মনে পড়ে যেত যে আমি কাকুকে কথা দিয়ে এসেছি বিদেশের জীবন নিয়ে লিখব।

কিন্তু কিভাবে?

আমার জীবনের ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে একটা সিরিজ বহু আগে থেকে লিখছিলাম--- জীবন যেমন। সেখানে বিদেশ জীবনের কথা বহুবার এসেছে। কাজেই নিজের জীবন নিয়ে আবার লিখবার ইচ্ছা শুরু থেকেই বাতিল করে দিলাম।

তারপর একেবারে হুট করে এ প্লটের আউটলাইন আমার মাথায় এল। যত একে নিয়ে ভাবি, নাড়াচাড়া করি, তত সেটা ডালপালা ছড়ায়। লিখতে গিয়ে আরো ছড়াল। একসময় পেন্সিলে পোস্ট করতে আরম্ভ করলাম। খুব ভালো রেসপন্স পেয়েছিলাম সেসময়। ঝটপট "জামী ইশতিয়াখ ফ্যান ক্লাব" ও "আদনান হায়দার হেট ক্লাব" গড়ে উঠল। প্রতিদিন সবার সাথে মতামত আদান প্রদান, হাসি ঠাট্টা করতে অসম্ভব ভালো লাগত।

উপন্যাসটিকে বই হিসেবে ছাপাবার বহু অনুরোধ আসতে থাকে। গল্প শেষ হয়ে যাবার বহুদিন পর পর্যন্ত।

আশা করি বইটি সবার মন জয় করে নিতে পারবে।

 

তাবাসসুম নাজ

মে, ২০২০।

LanguageBengali
Release dateMay 10, 2021
ISBN9798201600099
রুদাবা (Rudaba)
Author

তাবাসসুম নাজ

তাবাসসুম নাজের জন্ম ৩০ শে অক্টোবর। স্কুল কলেজ জীবনে টুকটাক লেখালেখি করতেন দেয়াল পত্রিকায়। এমবিবিএস শেষ করে বিদেশে বসবাস,  বাংলা লিখবার আর সুযোগ হয়নি। ২০১৭ সালে সন্ধান পান ফেসবুকভিত্তিক সাহিত্য গ্রুপ পেন্সিলের। নিয়মিতভাবে সেখানে লেখা দিতে থাকেন। এভাবেই তার প্রথম উপন্যাস হেডিসের রাজ্যে প্রকাশ পায়।    এবারে তিনি নিয়ে এলেন বড় আঙ্গিকের উপন্যাস--- রুদাবা। 

Related categories

Reviews for রুদাবা (Rudaba)

Rating: 5 out of 5 stars
5/5

2 ratings0 reviews

What did you think?

Tap to rate

Review must be at least 10 words

    Book preview

    রুদাবা (Rudaba) - তাবাসসুম নাজ

    রুদাবা

    তাবাসসুম নাজ

    রু...রু... ডাইনিং টেবিল থেকে চেঁচিয়ে ডাকল সিমিন।

    এই মেয়েটার যে কী হবে-—দশটার বেশী বাজে, এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এদিকে ওর আশায় বসে থেকে নাস্তার টেবিলও তোলা যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে থাকে সিমিন। নিশ্চয় রাতভর নেটে ছিল, বিয়ের শাড়ি লেহেঙ্গা দেখেছে আর আদনানের সাথে কথা বলেছে। যারজন্য ঘুমের খামতিটা এখন পুষিয়ে নিচ্ছে। এত এগোছালো জীবন যাপন! সব কিছুতে কেমন গড়িমসি, কেমন একটা গা ছাড়া ভাব। এর কপালে যে দুঃখ লেখা রয়েছে, তা যেন দিব্যচক্ষে দেখতে পেল সিমিন।

    সিমিনের আবার এসব একদম পছন্দ না। সে ভীষণ গোছানো স্বভাবের মানুষ। সময়ে নাস্তার পাট চুকিয়ে দিয়ে টেবিল পরিস্কার করে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলা হবে, তা না টেবিলজুড়ে এখনো পারাটা, ভাজি, ডিম, টিকোজি ঢাকা চায়ের পট, কাপ প্লেট সব বহাল তবিয়তে বসে রয়েছে আর সিমিনের দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকাচ্ছে। এরমাঝে সিমিন বিরক্তমুখে কেক বানাতে বসেছে। কেমন রাগটা লাগে!

    রু ওরফে রুদাবার রুম থেকে সিমিনের চার বছরবয়সী মেয়ে বের হয়ে এলো। গম্ভীরমুখে মা’কে জানালো-—খামি বলেছে ও এখন উঠবে না। ওর ঘুম শেষ হয়নি।

    শুনে সিমিনের চাঁদি যাকে বলে একেবারে জ্বলে উঠল। ঢং দেখো না। আবার রুমীকে দিয়ে খবর পাঠানো হয়েছে যে তিনি এখন উঠবেন না, তার ঘুম পুরা হয়নি!

    ভীষণ মুখ করে সিমিন রু’র উদ্দেশ্যে হুংকার দিল-—রু! এই মুহূর্তে উঠে পড় বলছি। রাতভর ঢং করে আদনানের সাথে গুলতানি করবার সময় খেয়াল ছিল না যে ঠিক সময়ে না ঘুমালে সকালে উঠতে পারবি না? তোর জন্য কতক্ষণ আমি নাস্তা নিয়ে বসে থাকব শুনি?

    রুমী তার ওপরে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেটা আবার পালন করতে গেল-—মা, খামি বলেছে...

    -—তুমি থাম। আসলেন খামির চ্যালা!

    তারপরও বোনের রুম থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে ফের চেঁচিয়ে উঠল—-রুদাবা! রুদাবা!

    রু এর বদলে পুরা নাম রুদাবা ধরে ডেকেছে, রু’ও এরপর আর শুয়ে থাকবার সাহস পেল না। ঘুমের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে পাল্টা চিৎকার করে উঠল

    -—এই যে আপু, এখুনি আসছি আমি মুখ হাত ধুয়ে।  

    রু উঠে পড়াতে সিমিনের রাগ মুহূর্তে পানি হয়ে গেল। সে পৃথিবীর সবার উপরে রাগ করে থাকতে পারে, একমাত্র রু বাদে। ওর উপর তার অন্যায়রকম পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। সেটা সবাই জানে। তার বাবা আমজাদ চৌধুরী, তার স্বামী ইমরান হক, এমনকি তার পুঁচকে চার বছরের মেয়ে রুমীও জানে সেটা। এবং তারা মেনেও নিয়েছে। সবাই জানে রু’কে কিছু বললে সিমিন বাঘের মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সিমিন নিজেও বোঝে যে রু’কে সে খুব বেশি রকমের প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। কিন্তু কিছুতে নিজেকে সামলাতে পারেনা। একে তো রু তার থেকে বয়সে অনেক ছোট। তার ত্রিশ আর রু’র বিশ। উপরন্ত দশ বছর আগে তাদের মা মনোয়ারা চৌধুরী যখন ক্যান্সারে ভুগে মারা গেলেন, তখন রু’র বয়স মাত্র দশ ছিল। সেই দশ বছর বয়সী মেয়েটার চোখের পানি বিশ বছরের সিমিনের বুকে যেন তীরের মত বিঁধেছিল। কাঁদতে কাঁদতে রু অসহায়ভাবে সিমিনকে বলেছিল-—আপু, কী হবে?

    বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সিমিন বলেছিল-—আমি তো আছি, তোর চিন্তা কীসের?

    সে থেকে রু’র মায়ের আসনটা যেন সিমিন অনেকখানি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু মায়ের স্নেহের ভূমিকাটুকু, শাসন সে একেবারেই করতে পারেনা তার মা-মরা বোনকে। তবে মাঝেমাঝে একটু ভাব দেখায় আরকি। এই যেমন একটু আগে দেখালো।

    -—এই রুমী, টমেটো দেখবে? ইয়া বড় বড় টমেটো ধরেছে গাছে। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে ইমরান রুমীকে ডাক দিল। রুমী সাথেসাথে ছুটে গেল। সিমিন ফের চেঁচিয়ে উঠল

    -—ওকে স্যান্ডেল পরিয়ে নিয়ে যেও। মাটি ভর্তি পা নিয়ে যেন ঘরে না ঢোকে।

    -—আচ্ছা, আচ্ছা, বাবা। ইমরান বউয়ের এসব অভ্যাসের সাথে খুবি পরিচিত।

    মেয়েকে বলল-—স্যান্ডেল পর, মামণি। নাহলে তোমার মায়ের কথার জ্বালায় সারাদিন তিষ্ঠাতে পারব না আমি।

    অমনি রুমী লক্ষ্মী মেয়ের মত স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে বাবার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে গেল।

    দেখে ঠোঁট টিপে হাসল সিমিন।

    বাবাকে সবসময়ের জন্য কাছে পেয়ে রুমী যেন খুশী আর ধরে রাখতে পারছে না। ঢাকা শহরে বাবাকে সারাদিনে কতটুকুই বা পায় রুমী? অসম্ভব ব্যস্ততায় দিন কাটে ইমরানের। দিনভর মেডিকেল কলেজে চাকরি, তারপর বাসায় ফিরে নাকেমুখে দুইটা গুঁজেই আবার চেম্বারে দৌড়। ছুটির দিনগুলিও মাঝেমাঝে পার পায় না। এনিয়ে সিমিন তেমন অনুযোগ করেনা। তার স্বামী কাজপাগল, এটা সে মেনে নিয়েছে। তাছাড়া ছয়বছর আগে জেদ করে যখন ইমরানকে সে বিয়ে করেছিল, তখন ইমরানের আর্থিক অবস্থা, সিমিন আর রু’র সফল ব্যবসায়ী বাবা আমজাদ চৌধুরীর ধারেকাছেও ছিলনা। আগ্রহটা সিমিনের দিক থেকে বেশি ছিল। ইমরানের তখন নড়বড়ে অবস্থা, এরমাঝে সিমিন কি মানিয়ে নিতে পারবে ভেবে সে বহুদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি সিমিনকে। যাহোক, সিমিনের আগ্রহে যখন বিয়েটা হল, তখন থেকে সে যেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। ইমরানের অহংবোধের ব্যপারটা সিমিন বোঝে, সে মত মানিয়েও চলে। কিন্তু বছরের মধ্যে দুইসপ্তাহ সে ইমরানসহ তাদের বাগানবাড়িতে চলে আসে নিরবিচ্ছন্ন ছুটি কাটাতে । এ ব্যাপারে সে কোনো আপোষ করেনা। এবারেও দুইদিন হল তারা এসে পড়েছে সিমিনের বাবা আমজাদ চৌধুরীর বাগানবাড়িতে। রাজেন্দ্রপুরে অবস্থিত বাগানবাড়িটা তেমন একটা বড় না তবে এর কম্পাউন্ডটা বিশাল। গাছ গাছালি দিয়ে চারিদিক একেবারে ভর্তি। একটা ছোট পুকুর পর্যন্ত রয়েছে, পুকুরের শান বাধানো ঘাঁটে বসে বিকেলের চা খাওয়া হয় নিয়মিত। বাড়ির কেয়ারটেকার সব্জী বাগান করে দক্ষহাতে। সেটাই ইমরান মেয়েকে দেখাতে নিয়ে গেল। রুমী তো জন্ম থেকে গাছে টমেটো ধরতে দেখেনি। দেখে খুশিতে যাকে বলে একেবারে আত্মহারা হয়ে গেল। দুইটা টসটসে টমেটো কেয়ারটেকারের কাছ থেকে উপহার পেয়ে বীরদর্পে মা’কে দেখাবার জন্য বাবাকে অস্থির করে তুলল।

    রুম থেকে বেরিয়ে ঝুপ করে সামনের চেয়ারে বসে পড়ল রু।—-গুড মর্ণিং, আপু।

    -—হুহ, গুড মর্নিং! মর্নিং এর আর বেশি বাকি নাই। তুই রোজ রাতে এত দেরি করে ঘুমাতে যাস কেন বল তো? রাত জেগে জেগে তোর চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে, তা জানিস?

    —-আপুউউ, একটা বিয়ে অর্গানাইজ করা কি কম ঝক্কির কাজ? কতকিছু দেখতে হচ্ছে। একটা দেখতে গিয়ে আরেকটা বেরিয়ে পড়ছে। কাল রাতে কী খুঁজে পেলাম জানো?

    -কী? কেকের ব্যাটার মাখাতে মাখাতে প্রশ্ন করল সিমিন।

    -—একটা ফেসবুক পেজ খুজে পেলাম, ওরা হলুদের ডেকোরেশনে ফুল সাপ্লাই দেয়। কী যে সুন্দর যদি দেখতে।

    —-এ আবার নতুন কী? হলুদে ফুল সাপ্লাই দেয়ার বহু লোক রয়েছে।

    —-আরে ধুর, এ সে না, আপু। এরা একদম নতুন কিছু করছে, এদের ফুল সত্যি না কিন্তু দেখতে আসল ফুলের মত। সিল্ক আর পেপার দিয়ে বানায়। আর কী চমৎকার সব ডিজাইন। দেখলে মাথা ঘুরে ওঠে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত মাহজাবীন আপু মানে পেজের ওনারের সাথে কথা বলছিলাম। আপু বলেছে শাড়ির সাথে কাসটম মেইড করে দেবে ফুলের গয়না। আবার ম্যাচ করে স্টেজের ডেকোরেশনও করে দিবে। ভালো না? তারপরে তো আদনানের সাথে এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। আদনানের অবশ্য এসবে ইন্টারেস্ট নাই। আমি জোর করে দেখালাম।

    —-বুঝলাম! এই এক বিয়ে করতে গিয়ে তুই পাগল হয়ে যাবি রে রু।

    -—পাগল এমনিতেই হয়েছি, আপু। আদনানের জন্য। রু’র ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।

    -—বেশরম! নে, নাস্তা করতে বস। তারপর আমাকে কেক ডেকরেশনে সাহায্য কর। ভাগ্যিস আসবার সময়ে ফ্রস্টিংটা সাথে করে এনেছিলাম। নাহলে বাপ বেটি দুজনের মুখ ভার হয়ে যেত।

    নাস্তার আয়োজনের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখল রু। তারপর নীচুস্বরে বলল

    -—আমি এসব খাব না, আপু।

    -—কেন? তোর প্রিয় জিনিস এসব। খাবি না মানে কী?

    -—খাব না, আপু। আমি একটা আপেল খাব শুধু।

    -—এত বেলায় আপেল দিয়ে নাস্তা? মারব এক থাপড়। জলদি খেতে বস বলছি।

    কাতর মুখ করে রু।-—সত্যি আপু। আমি এসব খেতে পারব না।

    ওর কথা বলার ধরণে কেমন সন্দেহ হয় সিমিনের। খাওয়া নিয়ে কোনো বায়নাক্কা নাই রু’র। হঠাৎ কী হল? 

    -—কেন খেতে পারবি না বল তো?

    কাচুমুচু মুখ করে রু জানায়-—আদনান বলেছে আমার ওজন বেড়ে গেছে! এভাবে চলতে থাকলে বিয়ের দিনে আমাকে ক্রেন দিয়ে তোলা লাগবে।

    দ্বিতীয়বারের মত ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল সিমিনের। আদনান বলেছে! আদনান বলেছে আর অমনি উনি খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে বসে রইলেন।

    -—রু, আদনান বলেছে শুনেই তুই খাওয়া বন্ধ করে দিলি? আমি তো কিছু দেখছি না। ঠাট্টা করে বলেছে হয়ত।

    -—না, আপু। আমি ওজন নিয়ে দেখেছি। সত্যি আমার ওজন পাঁচ পাউন্ডের মত বেড়ে গেছে।

    -—রু, ছুটিতে আছিস তাই। ইউনিভার্সিটিতে ফিরে দৌড় ঝাঁপ করলে কোথায় চলে যাবে পাঁচ পাউন্ড।

    কিন্তু রু’কে টলানো গেল না।-—আপু, আদনান মোটা মেয়েদের একদম দেখতে পারেনা। কত বাঁকা কথা বলে যারা মোটা হয়েছে, তাদের নিয়ে।

    শুনে সিমিন বিন্দুমাত্র খুশি হল না আদনানের উপর। কিন্তু রু’কে বলে লাভ নাই। সে অন্ধ হয়ে গেছে যেন আদনানের প্রেমে। সিমিন বুঝে উঠতে পারেনা এতখানি অন্ধ রু হয় কেমন করে? প্রেমে তো সিমিনও পড়েছে, কই এভাবে বুদ্ধিসুদ্ধি খুইয়ে বসেনি কখনো। নাকি সে-ই রু’কে বেশি আদর দিয়ে বাচ্চা বানিয়ে রেখে দিয়েছে। যার জন্য ওর ব্যক্তিত্বটা ঠিকমত গড়ে উঠতে পারেনি। এখনো যেন একটা কিশোরী মেয়ে রয়ে গিয়েছে রু। কে বলবে বিশ বছরের, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। অন্যের কথাকে, বিশেষ করে আদনানের কথাকে এত গুরুত্ব দেয় কেন সে?

    একটু কঠিনভাবেই বলল সিমিন-—খেতে বস, রু। সকাল থেকে নিয়ে বসে আছি কিন্তু। এখন আদনানের কথায় যদি না খাস তো আমার মেজাজ চড়তে দেরী হবেনা, আগেই বলে দিলাম।

    তারপরে বিড়বিড় করে বলল-—আর এ ছেলেটাই বা কী? এত অসভ্য কেন? আর তুই ওর কথাকে এত গুরুত্ব দিস, তোর নিজের একটা বুদ্ধি বিবেচনা নাই?

    রু কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসে রইল। তার খাবার ইচ্ছা নাই, এদিকে বোনের মুখের উপরে না করতেও পারছে না।

    ঠিক সে মুহূর্তে হুলুস্থুল করতে করতে ইমরান আর রুমী ঘরে ঢুকে পড়ল। রুমীর হাতে টুকটুকে লাল টমাটো দুটা। উত্তেজনায় তার মুখ টমাটোর মতোই লাল হয়ে গেছে। প্রবল উৎসাহে মার দিকে ছুটে এসে টমেটো দুটা বাড়িয়ে ধরল।-—মা, দেখেছ? আমাকে দিল। আমি গাছে টমেটো দেখেছি।

    সিমিনের মনোযোগ রু’এর দিক থেকে ঘুরে গিয়ে রুমীর উপরে পড়ল। ইমরানও ঘরে ঢুকে বলে-—তোমার কেক হতে আর কত দেরী? সকাল থেকে আশা দিয়ে রেখেছ!  

    সিমিন চেঁচিয়ে উঠল-—জুতা পায়ে সব ঘরে ঢুকে পড়লে কেন? পুরা ঘর মাটি দিয়ে ভর্তি হয়ে গেল! কী যে কর না তোমরা!

    এসব গোলমালে রু একটা আপেল হাতে সুড়ুত করে কেটে পড়ল। তার বহু কাজ। একটা বিয়ে কী কম হাঙ্গামা নাকি?

    গোলমাল খানিকটা শান্ত হতে সিমিন সব রাগ ঝাড়ল ওর বরের উপরে-—রু’র কান্ড দেখেছ? খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কী না আদনান বলেছে সে মোটা হচ্ছে, সেজন্য।

    ইমরান রু’কে কম ভালোবাসে না। ছোটবোনের মতোই দেখে তাকে। তবে সিমিনের মত অযথা দুশ্চিন্তা করে না। রু’টা একটু ছেলেমানুষ, এই আরকি। বয়স বাড়লে ঠিক হয়ে যাবে।

    রু’র পক্ষ নিয়ে বলল-—আহা, ওর যা খুশি তাই করতে দাও না। তুমি সবসময় ওর পিছে লেগে থাক কেন?

    -—পিছে লেগে থাকি? আদনান কেন বলবে ও মোটা হয়েছে? আর রু সেটাকে এত সিরিয়াসলিই বা নিবে কেন?

    সিমিনকে খুঁচিয়ে দিল ইমরান-—তুমি জেলাস যে রু আদনানের কথা বেশি শুনছে। তোমার কথা শুনছে না!

    বলা বাহুল্য, ভয়ংকর খেপল সিমিন। -—যাও, তোমার জন্য আমি কেক বানাচ্ছি না।

    হাসতে থাকে ইমরান-—না না, আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। সকাল থেকে বসে আছি, ডার্লিং। কেক না খাওয়ালে আমিও রু’র মত আজ থেকে শুধু আপেল খেয়ে থাকব।

    সিমিন হেসে ফেলল।

    রুমী তার ছোট্ট মতামত দিল-—মা, বাবাকে বকা দিও না।

    -—হয়েছে, আসলেন বাবার চ্যালা!

    হইচই হাসাহাসির মধ্যে সিমিন কেক ওভেনে ঢুকিয়ে দিল, ইমরানের সেলফোনটা বেজে উঠতে সে ফোন ধরতে বাইরে চলে গেল।

    ফোন সেরে ইমরান আবার ঘরে ঢুকল, চেহারায় চিন্তার ছাপ। সিমিন লক্ষ্য করল না, কাজ করতে করতে বলল

    -—এই তো আর আধাঘন্টা। আধাঘন্টার মধ্যে তুমি যার জন্য হা পিত্যেস করে বসে আছ, সেই কেক রেডি হয়ে যাবে। 

    কথার জবাব না দিয়ে ইমরান এগিয়ে এসে সিমিনের কাঁধে দুইহাত রাখে। হাল্কা গলায় বলে-—সিমিন, তুমি আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসো, তাই না?

    সন্দেহের চোখে তাকায় সিমিন-—হঠাৎ সাত সকালে ভালোবাসা একেবারে উথলে পড়ল! কী অপকর্ম করে ফেলেছ এর মধ্যেই শুনি?

    -—আহা! অপকর্ম করতে যাব কেন? আমি তোমাকে খুবি ভালোবাসি। জানতে চাইছি তুমিও আমাকে সমান ভালোবাসো কিনা?

    ইমরানকে এক ঠ্যালা দেয় সিমিন।-—থাক, আর আহ্লাদ করতে হবে না। আসল কথাটা বল। এসব ভালোবাসার কথা অনেক শুনেছি।

    কাচুমুচু মুখ করে ইমরান-—সত্যি একটা কাজ করে ফেলেছি যে! শুনলে তুমি মনে হয় খুশি হবে না!

    -—ইমরান! এত ভনিতা না করে আসল কথাটা বলবে? তুমি কি আগেভাগে ফিরে যাবার কথা ভাবছ নাকি? তাহলে উত্তর হবে একদম না।

    -—না না, ফিরে যাবার কথা বলছি না। এ অন্য ব্যাপার।

    -—এত সাসপেন্স তৈরি না করে বল না কী হয়েছে।

    ইমরান তখন তখনি খুলে বলে না। ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। সে জানে সিমিনের কাছে এ দুই সপ্তাহের ছুটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর ধরে বেচারি তাকিয়ে থাকে সময়টার দিকে। এটা একটা পারিবারিক ভ্যাকেশন। সিমিনের বাবাও এতে শামিল হন না। তখন ইমরান শুধু সিমিন আর রুমীকে সময় দেয়। সেজন্য ঝোঁকের মাথায় যে কাজটা সে করে ফেলেছে, শুনলে সিমিন ক্ষেপে আগুন হয়ে গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নাই।

    -—একটু আগে আমার এক বন্ধু ফোন করেছিল, বুঝলে? ওর নাম জামী। আমার বহু পুরানো দোস্ত। আমরা একসাথে স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজে পড়েছি। এমনকি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে একরুমে পর্যন্ত থেকেছি। আমার জানের দোস্ত।

    -—তাই? তোমার এত জানের দোস্তকে আমি ছয়বছরেও দেখলাম না কেন?

    -—কারণ পাশ করার পরপর সে কানাডায় চলে যায়। আর তারপরে তোমার সাথে আমার দেখা হয়। যারজন্য তুমি ওকে দেখোনি।

    -—আচ্ছা। তারপর?

    -—তারপর যা হয় আরকি। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমার ক্যারিয়ার নিয়ে। জামীও তাই। দুজনের মধ্যে যোগাযোগটা কমতে কমতে নাই হয়ে গেছিল। এতদিন সে দেশেও আসেনি। ওর বাবামা আর বেঁচে নাই তো, তাই। একটা বড় বোন অবশ্য আছে, সেও ওখানে থাকে। দেশে আসবার তাই তেমন গরজ ছিলনা।

    দুইদিন হল সে দেশে এসেছে। এসেই কার কাছ থেকে আমার নাম্বারটা জোগাড় করেছে। এতক্ষণ অনেক কথা বললাম আমরা।

    একটু চুপ করে থাকে ইমরান। আসল বোমাটা ফাটাবার আগে পরিস্থিতি যাচাই করে নিতে চায়। সিমিন কিছু বলছে না দেখে আবার শুরু করে

    -—এসে ও হোটেলে উঠেছে, সিমিন। শুনে আমার এত খারাপ লাগল যে কী বলব। আমি থাকতে আমার প্রাণের বন্ধু হোটেলে উঠবে? আমি ওকে আমাদের বাসায় থাকবার কথা বলে ফেলেছি।

    -—ওহ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সিমিন।-—এ আর এমন কিছু কী। অবশ্যই উনি থাকবেন আমাদের বাসায়। উনাকে বল আমরা ফিরে গেলে যেন সাথেসাথে আমাদের ওখানে শিফট করে চলে আসে।

    ইমরানের চেহারায় আগের কাচুমুচুভাব ফিরে এল।-—ইয়ে সিমিন। আমি তার আগেই ওকে চলে আসতে বলে ফেলেছি যে।

    -—তার আগে? কবে আসতে বলেছ? আশ্চর্য হয়ে গেল সিমিন।

    -—কাল সকালে একটা কার রেন্ট করে আসতে বলে দিয়েছি!  

    -—কাল! স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল সিমিন।-—কাল মানে এখানে আসতে বলেছ তাকে, ইমরান? তুমি জানো না এ সময়টা আমাদের নিজস্ব সময়? এটা আমার কাছে কতখানি ইম্পর্ট্যান্ট? আর তুমি সেখানে সম্পূর্ণ অচেনা এক লোক এনে ঢোকালে?

    -—অচেনা না, সিমিন। আমার বাল্যবন্ধু।

    -—তোমার বাল্যবন্ধু হতে পারে কিন্তু আমার কাছে তো অপরিচিত। এ কাজটা তুমি কেন করলে আমাকে বল দেখি?

    -—সরি, সিমিন। ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছি। বন্ধুকে হঠাৎ পেয়ে আমার খেয়াল ছিলনা।

    অসন্তস্টমুখে সিমিন বলতে থাকে-—চিনি না, জানি না। এই ছোট বাসা। আমি তো কখনো এসবে আপত্তি করিনা, ইমরান। কিন্তু সময়টা তো দেখতে হবে। তুমি তাকে ঢাকায় আমাদের বাসায় আসতে বলতে, আমি খুশি হতাম! খুব খারাপ একটা কাজ করলে কিন্তু, ইমরান।

    ইমরান কিছু না বলে অপরাধী মুখ করে বসে রইল।

    সিমিন কিছুক্ষণ গজগজ করে। তারপর ইমরানের গোবেচারা মুখ দেখে তার মনে দয়ার উদ্রেক হয়।-—আচ্ছা, থাক। এমন মুখ করে বসে থাকতে হবে না। বলেই যখন ফেলেছ তখন কী আর করা।

    মুহূর্তে হাসিতে মুখ ভরে গেল ইমরানের। উঠে এসে সিমিনের গালে চটাস করে চুমু খেয়ে বলল-—এই না হলে আমার বউ!

    সিমিন ধাক্কা দিয়ে ইমরানকে সরালো। -—রু কখন এসে পড়ে! কী যে কর!

    -—বাহ, রু’র কয়দিন পর না বিয়ে। ওর এসব জানতে হবে না!

    হঠাৎ সিমিন বাজপড়া মুখে বলে উঠল-—সর্বনাশ করেছে!

    -—কী হল আবার?

    -—তোমার বন্ধু কোথায় থাকবে? রুম মাত্র তিনটা।

    -—কেন, একটাতে আমরা, একটাতে রু আর একটাতে জামী থাকবে। অসুবিধা কোথায়?

    -—আর আদনান যে আসছে, সে কোথায় থাকবে শুনি?

    -—আদনান আবার আসছে নাকি? এটা তো জানতাম না।

    -—আমিও জানতাম না। কিন্তু তোমার গুণধর শ্যালিকা তাকে আসতে বলেছে। এখন হবু জামাইকে সেইমত আপ্যায়ন করতে তো হবেই।

    একটু চিন্তিত দেখায় ইমরানকে। পরমুহূর্তে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার—-এক কাজ করো।

    -—কী? উৎসুক দেখায় সিমিনকে।

    -—কলমা পড়িয়ে দাও দুজনকে। প্রবলেম সলভড। আমরা একরুমে, রু-আদনান একরুমে আর জামী একরুমে। ব্যাস, ঝামেলা চুকে গেল!

    আশা নিয়ে সিমিন ইমরানের কথা শুনতে গেছিল। হয়ত ইমরানের কাছে এর একটা সুরাহা আছে ভেবে। কিন্তু ওর কথায় মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার।

    -—সবসময় ঠাট্টা করবে না তো। আর রু’র কানে খবরদার কথাটা তুলবে না। বিয়ে পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা। এসব আইডিয়া একদম ওর মাথায় ঢোকাবে না বলে দিলাম।

    -—আচ্ছা আচ্ছা, বলব না। কিন্তু আরেকটা কাজ করা যায়।

    -—কী কাজ? উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মেজাজ খারাপ করে দিবে না বলে দিলাম কিন্তু।

    -—না, না। ভালো আইডিয়া। গেস্টদেরকে তিন বেডরুম ছেড়ে দিয়ে আমরা নাহয় ড্রয়িং রুমে সোফাবেডে থাকি। কী বল?

    জ্বলে উঠল সিমিন।

    -—আহা, কী বুদ্ধি। দুইদুইটা জোয়ান লোকের সামনে আমি ড্রয়িংরুমে শুয়ে থাকব? ছি ছি।

    -—ওদের সামনে কেন থাকবে? ওরা রুমে থাকবে, তুমি শোবে আমার সাথে। আপত্তি আছে তোমার?

    রাগ করে উঠে পড়ল সিমিন। ইমরানের সাথে কথা বলাই বৃথা।

    -—খুবি আপত্তি আছে।

    ইমরান দুঃখ দুঃখ মুখ করে

    Enjoying the preview?
    Page 1 of 1